বিজ্ঞাপণের জন্য যোগাযোগ করুন- 01966555312

শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের ২৪ তরুণ ও যুবককে লিবিয়ার জিম্মিদশা থেকে ফিরে পেতে স্বজনদের মানববন্ধন

নিজস্ব প্রতিবেদক:
পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে স্বপ্নের খোঁজে দালালের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার জন্য ঘর ছাড়েন শরীয়তপুরের ১৯ জন ও মাদরীপুরের ৫ জন তরুণ ও যুবক। কিন্তু তারা ইতালি পৌঁছাতে পারেননি। তারা এখন কোথায় আছেন, তা জানেন না স্বজনরা। ৯ মাস ধরে তাদের সন্ধান দিতে পারছে না কেউ। তাদের সন্ধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেও কোন লাভ হয়নি।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের ১৮ জন এবং মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকার ৫ জন তরুণ ও যুবকের স্বজনরা প্রিয়জনের অপেক্ষায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। নিখোঁজদের সন্ধান চেয়ে তাদের পরিবারের সদস্যরা রোববার(৮ ডিসেম্বর) শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন। জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন।

মানববন্ধনে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানায়, পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে গত মার্চ মাসে দালালের মাধ্যমে ইতালির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় শরীয়তপুরের ১৯ জন ও মাদারীপুরের ৫ জন তরুণ ও যুবক। পরে তাদের ইতালি পৌঁছানোর কথা বলে লিবিয়ায় মাফিয়া চক্রের হাতে তুলে দেয়া হয়। একপর্যায়ে তাদের জিম্মি করে নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে বেশ কয়েক দফায় লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এরপরও তাদের মুক্তি দেয়া হয়নি। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করলে উল্টো ভুক্তভোগী পরিবাকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা। দ্রুত মানবপাচারকারীদের জিম্মিদশা থেকে স্বজনদের মুক্তি ও টাকা ফেরতের দাবী জানিয়েছেন তারা।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা আরও জানান, শরীয়তপুর সদরের আংগারিয়া ইউনিয়নের চরযাদবপুর গ্রামের রাশেদ খান তার দুই সহযোগীর মাধ্যমে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশে পাঠান। লামিসা এন্টারপ্রাইজ নামের তার একটি প্রতিষ্ঠান আছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে শরীয়তপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ মধ্যপাড়া এলাকার আল আমিন ভূঁইয়া, দক্ষিণ ভাসানচরের দিদার হোসেন, মোহাম্মদ ফারুক সরদার, নতুন হাট এলাকার আলদিন রিমন, চর নেয়ামতপুর এলাকার রাশিদুল, সিরাজ, আতিকুর রহমান, চর ভাসানচরের আমিনুল ইসলাম, চাপাতলীর সরদার সাদেকুল, চরচাটাং এলাকার মিরাজ ওঝা, রফিক মোড়ল, শামীম গাজী, জাগীর এলাকার মোহাম্মদ পারভেজ, দরিরচর দাদপুরের জাফর শেখ, জাফরাবাদের দিপু সিকদার, ত্রিভাগাদির শাহজাহান হাওলাদার, কদমতলী এলাকার শাহীন সিকদার, সূর্যমনির সাইফুল ইসলামসহ ২৫ তরুণ ও যুবককে অবৈধ পথে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাঠানোর জন্য বাড়ি থেকে নিয়ে যান। এ জন্য পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে ১২ থেকে ২০ লাখ টাকা করে নেয় দালাল।

স্বজনরা জানান, নিখোঁজদের প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর হয়ে লিবিয়ায় নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন লিবিয়ায় দুই দফা পুলিশের হাতে আটক হয়ে কারাগারে যান। কয়েকজনকে জিম্মি করে নির্যাতন করা হয়। পরে স্বজনদের থেকে টাকা নিয়ে তারা জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পান। কিন্তু গত ২১ ও ২২ মার্চ থেকে ওই ২৪ জনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না স্বজনরা। তারা কোথায় কীভাবে আছেন, তা-ও জানেন না স্বজনরা। দালাল রাশেদ গ্রামের বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছেন। ঢাকার পল্টনে তার কার্যালয়টিও বন্ধ। স্বজনরা নিখোঁজদের সন্ধান চেয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন।
জেলা সদরের দক্ষিণ মধ্যপাড়া এলাকার আল আমিন ভূঁইয়া(২৫) ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিলেন। সংসারের অভাব দূর করতে তিনি সাড়ে ১২ লাখ টাকা দিয়ে ২০২৩ সালের জুনে বাড়ি ছাড়েন। তাকে প্রথমে লিবিয়ায় নেওয়া হয়। এরপর পুলিশের হাতে আটক হয়ে ৭৫ দিন জেল খাটেন আল আমিন। এরপর সমুদ্রপথে ইতালি নিতে তাকে ত্রিপোলি শহরে নেওয়া হয়। ২২ মার্চ থেকে তাঁর সঙ্গে স্বজনদের যোগাযোগ নেই।

ভুক্তভোগী আল আমিনের বাবা চুন্নু ভূঁইয়া বলেন, মাফিয়ারা কয়েক দফায় ২৮ লাখ টাকা নিয়েছে। আমি সহায় সম্বল বিক্রি করে তাদের হাতে টাকা দিয়েছি। কিন্তু এখনো জানিনা আমার ছেলে লিবিয়ায় কি অবস্থায় আছে। আমি দালালদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছি। আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই আর দালালদের বিচার চাই।

৪ বছর বয়সী কন্যাশিশুকে কোলে নিয়ে মানববন্ধনে আসেন লাবনি আক্তার। তার স্বামী সাইফুল ইসলাম ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়ায় নিখোঁজ হয়েছেন। লাবনি বলেন, সর্বশেষ ২২ মার্চ স্বামীর সঙ্গে কথা হয়। তখন জানিয়েছিলেন, তারা সমুদ্রপথে লিবিয়া থেকে ইতালিতে যাত্রা করবেন। এরপর ৯ মাসের বেশি সময় হয়ে গেছে, তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।

আয়েশা আক্তারের স্বামী সিরাজ মৃধা(৩৫) নিয়ামতপুর গ্রামে কৃষিকাজ করতেন। তিনি শিশুসন্তান নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। স্বপ্নের খোঁজে ঋণ করে স্বামীকে ইতালিতে পাঠান। এ জন্য দালাল রাশেদকে ৫ লাখ টাকা দেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সিরাজ গ্রাম ছাড়েন। প্রথমে তাকে দুবাইতে নেওয়া হয়। এরপর যান মিসর। সেখান থেকে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে নেওয়া হয়। এরপর কিছুদিন রাখার পর ট্রলারে করে সমুদ্রপথে ইতালি নেওয়ার উদ্যোগ নেয় দালাল চক্র। এর মধ্যে সিরাজকে লিবিয়ার একটি চক্র জিম্মি করে স্বজনদের কাছে মুক্তিপণ চায়। স্বামীকে বাচাতে আয়েশা ৬ শতাংশ জমিসহ বসতবাড়ি বিক্রি করে চক্রের কাছে ৮ লাখ টাকা পাঠান। সিরাজ ২১ মার্চ ফোন করে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই।
মানববন্ধন অংশ নিয়ে মাদারীপুরের শাজাহান হাওলাদারের মা মেহেরজান বলেন, আমার সন্তান বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে কিছুই জানিনা। দালাল মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে আমার সন্তানকে লিবিয়ায় আটকে রেখেছে। ভিটা বাড়ি বিক্রি করে তাদের টাকা দিয়েছি, কিন্তু এরপরও তারা আমার সন্তানকে ছাড়েনি। আমি আমার সন্তানকে ফেরত চাই। 

শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, 'শরীয়তপুরের কয়েকজন ব্যক্তি মানব পাচারের শিকার হয়েছেন তা বিক্ষিপ্তভাবে জেনেছি। ভুক্তভোগী পরিবার মামলা করলে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে। এখন যেহেতু বিষয়টি জেনেছি, ছায়া তদন্ত শুরু করা হবে।'

Post a Comment

Thnaks For Comment

Previous Post Next Post