আমার বাবা আসলেও কাজ করতে টাকা “ঘুষ” নিবো, আপনি দিবেন না কেন?। এমন কথাই এক সেবা গ্রহীতাকে বলতে শোনা গেছে শরীয়তপুরের এক ভূমি কর্মকর্তাকে। তার ওই কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ ওই কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে ভূমি সংক্রান্ত প্রতিটি কাজে ঘুষ নেন। টাকা ছাড়া কোনো নথির কাজ আগায় না। নামজারি, খাজনা আদায়, দলিল যাচাই সবকিছুতেই তার অফিশিয়াল ফি’র বাইরে ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে হয়।
ভাইরাল হওয়া ওই কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস মিয়া শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার পূর্ব ডামুড্যা ইউনিয়নের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। ভাইরাল অডিওতে শোনা যায়, এক সেবা গ্রহীতা জমির নামজারি সংক্রান্ত কাজ করতে গেলে কর্মকর্তা ঘুষ দাবি করেন। তার চাহিদামত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমার বাবা আসলেও টাকা ছাড়া কাজ করবো না। আপনি দিবেন না কেন?” কিছুদিন আগে আমার এক নিকট আত্মীয় নামজারি করছে সেও টাকা দিছে। তুমি পরিচিত মানুষ কিছু টাকা কম দাও। সবাই সাত হাজার দেয় তুমি পাঁচ হাজার দাও। টাকা ছাড়া কাজ করা সম্ভব না। বর্তমানে অফিসে প্রচুর খরচ হয় সেটা তো তুমি দিবে না। ভিডিওটি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই এলাকাজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সাধারণ মানুষ বলছে, এমন নির্লজ্জ বক্তব্যে যেমন সরকারি কর্মকর্তাদের মানহানি হয়েছে, তেমনি প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা আরও কমে গেছে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইদ্রিস মিয়া ১৯৮৯ সালে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে উপ-সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি গোসাইরহাটের গরীবের চর, কোদালপুর, গোসাইরহাট ইউনিয়ন ভূমি অফিস, শরীয়তপুর সদর, ভেদরগঞ্জের রামভদ্রপুর, ডামুড্যা উপজেলার সিধলকুড়া ও সর্বশেষ পূর্ব ডামুড্যা ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করছেন। দায়িত্ব পালনকালে তিনি সেবা গ্রহীতাদের নিকট থেকে খাজনা, খারিজ, নামজারিসহ বিভিন্ন কাজে সরকারি ফি’য়ের চেয়ে অতিরিক্ত ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত গ্রহণ করেন। এতে সেবা গ্রহীতাদের আর্থিক ক্ষতিসহ জমির মালিকানা নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে চাকুরি করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এর আগে রামভদ্রপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে একইভাবে ঘুষ লেনদেনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সেখান থেকে তাকে পূর্ব ডামুড্যা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে বদলি করা হয়। এছাড়াও গত বৃহস্পতিবার সকালে প্রায় শতাধিক ভুক্তভোগী তার অফিসের সামনে এসে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করে। এসময় তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে অপসারণের দাবি জানায়। পাশাপাশি তার দুর্নীতির তদন্ত করে কঠিন শাস্তির দাবী জানান।
সেবাগ্রহীতা রুমা আক্তার নামে ওই তরুণী বলেন,“আমি আমার বাবার নামজারি করতে গিয়েছিলাম। কাগজপত্র সব ঠিক থাকলেও কর্মকর্তা টাকা দাবি করেন। আমি রাজি না হলে উনি হেসে বলেন, ‘আমার বাবা আসলেও ঘুষ নিবো, আপনি দিবেন না কেন?’ এমন কথা সরকারি অফিসে শুনে খুব খারাপ লেগেছে। তখনই বুঝি, ঘুষ না দিলে এই অফিসে কাজ হয় না। যতটুকু জেনেছি ওনি টাকা ছাড়া কোন কাজ করেন না। আমি রেকর্ড রাখি কারণ উনি প্রকাশ্যে টাকা দাবি করেন। পরে সেই অডিওই ভাইরাল হয়েছে।
পূর্ব ডামুড্যা এলাকার বাসিন্দা রুমা বেগম বলেন,
“আমার স্বামীর রেখে যাওয়া জমির খাজনা দিতে গিয়েছিলাম। উনি বললো খাজনা প্রায় দশ হাজার টাকা হয়েছে। আমি তাকে বললাম এতো টাকা কিভাবে দিবো। উনি আমাকে বলে আপনি পাঁচ হাজার টাকা দেন আমি খাজনা কেটে দিচ্ছি। পাশাপাশি উনি বললো আগে খরচা দিতে হবে তারপর কাজ হবে। আমি গরিব মানুষ এতো টাকা দিতে পারব না। উনি তখন বলেন সবাই দেয় আপনি দেবেন না কেন?। এই কথা শুনে অপমানিত বোধ করেছি। শেষে বাধ্য হয়ে চার হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
ভুক্তভোগী এক ব্যবসায়ী মিজান হোসেন বলেন,“জমির মালিকানা পরিবর্তনের কাগজের জন্য দুই মাস ধরে দৌড়াচ্ছি। প্রতিবার উনি বিভিন্ন অজুহাত দেন। শেষবার সরাসরি বলেন কাজটা করতে হলে কিছু(টাকা)দিতে হবে। তখন উনি আমার থেকে দুই হাজার টাকা নিয়েছে। আমি নিরূপায় হয়ে টাকা দিয়েছি। টাকা না দিলে উনি কাজ করবে না।
ভাইরাল কথোপকথনের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত পূর্ব ডামুড্যা ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ইদ্রিস বলেন, ‘‘এই ভিডিও এডিট করা আমি কোন টাকার কথা বলিনি। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে। তবে ভিডিওটি দেখাতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।’’
এ বিষয়ে ডামুড্যা উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভূমি) মো: তারিকুল ইসলাম বলেন, “তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তিনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার বক্তব্য দিয়ে যাবেন। যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
